রূপবান সিনেমাটি নিয়ে লেখার সময় আসুন আমরা হুমায়ুন আহমেদকে একদফা স্মরন করে নেই। লেখক হুমায়ুন আহমেদের আগে বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় মূলত কলকাতার লেখকদের দাপট ছিল।
বলা চলে হুমায়ুন আহমেদই তাদের এখান থেকে সোজা বের করে দেন। হুমায়ুন আহমদের মৃত্যুর পর আনন্দবাজার পত্রিকায় তাকে নিয়ে লিখেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘সম্রাট হুমায়ুন’।
একবার বাংলা একাডেমির বইমেলায় ঢুকে শীর্ষেন্দু দেখলেন একটি স্টলকে ঘিরে লম্বা লাইন! খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, হুমায়ুন আহমেদের বই কিনে তাঁর অটোগ্রাফ নেবার জন্যে এটি তাঁর ভক্তদের লাইন!
এমন দেখেশুনে একজন লেখক হিসাবে মুগ্ধ শীর্ষেন্দু লিখেছিলেন, একজন লেখকের বই কেনা-অটোগ্রাফ নেবার এমন লম্বা লাইন দুই বাংলায় এর আগে কখনও ঘটেনি। এরজন্যেই তিনি সম্রাট হুমায়ুন। তাঁকে কূর্নিশ।
তেমন রূপবান সিনেমাটি নিয়েও ঢাকার সিনেমা জগতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। ‘মুখ ও মুখোশ’ এর মাধ্যমে ঢাকায় সিনেমা বানানো শুরু হয়েছে। এরপর বেশ কিছু ছবি বানিয়ে বেশ ক’জন নির্মাতা প্রতিভার পরিচয় দেন।
তখন ‘এদেশ তোমার আমার’, ‘ধারাপাত’ ‘যে নদী মরু পথে’, ‘রাজধানীর বুকে’ ‘হারানো দিন’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘সুতরাং’ ‘নদী ও নারী’ এসব ছবি বানিয়ে নির্মাতারা প্রশংসা পাচ্ছিলেন।
কিন্তু ছবিগুলো মুনাফা করতে পারছিলোনা। সিনেমায় টাকা লগ্নি করতে হয়। এই লগ্নি যদি না ওঠে, মুনাফা যদি না করে তাহলে প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী-কলাকুশলী, হল মালিকরা টিকতে পারেননা।
তখন ঢাকায় লাহোরের উর্দু ছবির দাপট। ঢাকার নির্মাতারাও তখন কড়ির জন্যে ঝুঁকে পড়েন উর্দু ছবি নির্মানে! এহতেশাম, মুস্তাফিজ সহ আরও একাধিক পরিচালক চান্দা, তালাশ, মালা, সঙ্গম, তানহা, চকোরী এসব উর্দু ছবি বানিয়ে সাফল্য পেলেন।
১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ঢাকায় বাংলা ছবি বানানো হয় ১৪টি। একই সময়ে ১৮টি উর্দু সিনেমা বানানো হয়। তখন একটি বিপ্লব ঘটালো রূপবান সিনেমাটি। ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো কোন হৈচৈ করা রাজনৈতিক গল্পের ছবি এটি নয়।
স্রেফ গ্রামবাংলার লোক কাহিনীর ছবি। গ্রামেগঞ্জে পুঁথি-পালাগানের গল্প নিয়ে ছবি। যে গল্পগুলো গ্রামের মানুষ পুঁথি সাহিত্য, যাত্রা-পালাগানের কারনে জানেন। বারো বছরের বালিকা কন্যা রূপবান।
যার সঙ্গে বারো দিন বয়সের রাজপুত্রকে বিয়ে দিয়ে পাঠানো হয় বনবাসে! সেই রহিম আবার বড় হয়ে মত্ত হয় তাজেলের প্রেমে। এ নিয়ে রূপবানের কান্নায় কেঁদেকুটে একাকার হন হল ভর্তি দর্শক!
সালাহউদ্দিন নামের এক প্রযোজক-পরিচালক ছবিটি বানান। তাঁর অনুপ্রেরনা অবশ্য ছিলেন সফদর আলী ভূঁইয়া ও সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া নামের দুই ভাই। যারা অনেক দিন ধরে ছবিটির পরিকল্পনা করছিলেন। বানানোর লোক পাচ্ছিলেননা।
১৯৬৫ সালে ছবিটি বানানো হয়। ঢাকা, সিলেট, সাভার, মধুপুরে ছবিটির শুটিং হয়। কুষ্টিয়ার মেয়ে তন্দ্রা মজুমদার সুজাতা নাম নিয়ে রূপবান চরিত্রে অভিনয় করেন। এই এক ছবিই তাঁকে রাতারাতি তারকা খ্যাতি এনে দেয়।
সুজাতার নাম হয়ে যায় রূপবান কন্যা। চলচ্চিত্র বোদ্ধারা ছবি পছন্দ করেননি। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামের মানুষজন তাদের চিরচেনা কাহিনীর সিনেমা রূপ দেখে দারুনভাবে ছবিটি লুফে নেয়।
ছবিটিতে আরও অভিনয় করেন মনসুর, সিরাজুল ইসলাম, ইনাম আহমেদ, আনোয়ার হোসেন ও সুভাষ দত্ত। সবাই যার যার চরিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সব প্রশংসা যায় রূপবান কন্যা সুজাতার একাউন্টে!
সত্য সাহার সুরে আব্দুল আলীম, নীনা হামিদের কন্ঠে গাওয়া রূপবান ছবির গানগুলো হাটে ঘাটে মাঠে তুমুল জনপ্রিয় হয়। ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কয়েকটি সিনেমাহলে ছবিটা টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে!
দূরের গ্রামের মায়েরা-মেয়েরা গরুর গাড়ি-মহিষের গাড়িতে চড়ে ছবিটি দেখতে আসতেন। বলতে গেলে ছবিটি উর্দু ছবিকে সিনেমা হল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল! ঢাকায় উর্দু ছবির দাপট থামিয়ে দেয়া রূপবান ছবির সাফল্যে তখন এ ধরনের ছবি নির্মানের হিড়িক পড়েছিল।
এমন গুনাই বিবি, মধুমালা, সাত ভাই চম্পা, মহুয়া, বেহুলা, আলোমতি, রাখাল বন্ধু, অরুন বরুন কিরনমালা, পাতালপুরীর রাজকন্যার মতো বিস্তর ছবি তখন বানানো হয়। এই ধারা মালকাবানু, বেদের মেয়ে জোস্না পর্যন্ত চলেছে।
সুজাতার রূপবান চরিত্রটি ছিল উজিরের বারো বছরের বালিকা কন্যা, যাকে বারো দিন বয়সী রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পাঠানো হয় বনবাসে। রূপবানের বাবা উজির চরিত্রে অভিনয় করেন তেজেন চক্রবর্তী।
মনসুর অভিনয় করেন রহিম চরিত্রে। বাদশার অনেক সাধনার ছেলে। বারো দিন বয়সে যাকে রূপবানের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পাঠানো হয়েছিল বনবাসে। তার বাবা একাব্বর বাদশা হন সিরাজুল ইসলাম।
তাজেল চরিত্রে অভিনয় করেন চন্দনা। সায়েদ বাদশার চরিত্রটির অভিনেতা ছিলেন ইনাম আহমেদ। জংলি সর্দার হন আনোয়ার হোসেন। একাব্বর বাদশার স্ত্রী তথা রহিমের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন তন্দ্রা ইসলাম।
ধাইমা হন হেলেন। জ্যোতিষী-রানু, দরবেশ-আকবর, রহিমা-মাসী, নুরুল আনাম খাঁ-দাদু, জল্লাদ-আয়াজ এবং অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেন সুভাষ দত্ত।
‘ও ধাইমা কিসের বাদ্য বাজেগো আমার ধাইমা, ধাইমাগো’, ‘বিদায় দেন বিদায় দেন আব্বাগো’, এরকম প্রায় ৩০টি গান ছিল পুরো ছবিতে। যা মানুষের মুখে মুখে ছিলো। “ঢেউ উঠেছে সাগরে”(আব্দুল আলীম), “বাড়িরও দক্ষিণপাশে”(নীনা হামিদ-কুসুম হক), “শোনেন দাদু”(নীনা হামিদ-কুসুম হক), “মেরোনা জল্লাদ”(নীনা হামিদ) গানগুলো তুমুল জনপ্রিয় হয়।
ছবিটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানান স্মৃতিচারন করেন সুজাতা। গৌরব নিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁকে রূপবান ডাকেন। একবার মজার একটি স্মৃতিচারন করেছিলেন সুজাতা।
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ছবিটির কিছু অংশের শুটিং হয়। একটা দৃশ্য ছিল তাজেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে রহিম বাদশা। তাজেলের প্রতি রহিম বাদশার এমন আসক্ত হওয়ায় কাঁদতে কাঁদতে একটি বাঁশ ধরে গান গেয়েছিল রূপমান।
সেই বাঁশটি পরে নিলামে বিক্রি হয়েছিল। রূপবান কন্যার ভক্ত যে লোকটি নিলামে বাঁশটি কিনেছিল তাঁর সঙ্গে সুজাতার একবার দেখা হয়েছিল। তখন বুড়িয়ে গিয়েছিলেন সেই ভক্ত।
সুজাতাকে একবার কোথাও দেখে তিনি বলেন, আপনি আমাকে চিনবেননা। আপনি রূপবান ছবিতে যে বাঁশটি ধরে গান গেয়েছিলেন সেটি আমি কিনে নিয়েছিলাম। কারন গ্রামের অনেক রূপবান ভক্ত বাঁশটি দেখতে আসতো।
পাকিস্তান আমলে দেই বাঁশটির দাম বড়জোর এক আনা ছিল। কিন্তু সেই ভক্ত তখন নিলামে সাড়ে পাঁচশ টাকায় বাঁশটি কিনে তাঁর গৌরবের সংগ্রহে রেখে দেন।
রূপবান ছবির গুনে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকাই ছবির দাপুটে নায়িকা হিসাবে সুজাতা রহিম বাদশা ও রূপবান, জরিনা সুন্দরী, আগুন নিয়ে খেলা, কাঞ্চনমালা, আলিবাবা, মধুমালা, গাজী কালু চম্পাবতী, তানসেন, আলোর মিছিল, টাকার খেলা, বেঈমান, সাহেব বিবি গোলাম সহ আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করেন।
স্বামী আজিম ছাড়াও মেহমুদ, আনসার, সরকার কবির উদ্দিন, হাসান ইমাম, রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, আলমগীর, ওয়াসিম, মান্নান, জাভেদের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন সুজাতা।
বাংলাদেশের ছবির জগতের চলতি দূর্দশা কাটাতে দরকার রূপবানের মতো আরেকটি সিনেমা বিপ্লব।