শরণার্থী হিসাবে ঢাকায় আসা রাজ্জাক হয়ে উঠেছিলেন ঢালিউডের নায়করাজ

শরণার্থী হিসাবে ঢাকায় এসেছিলেন রাজ্জাক। তাঁর বড় ছেলে বাপ্পারাজ তখন কোলের শিশু। স্ত্রী-সন্তানকে শরণার্থী শিবিরে রেখে তিনি কাজ খুঁজতে বেরোন। এক ফিল্ম অফিসে কর্মচারীর একটা কাজ পেয়েও যান।

সেই কাজটি পাবার পর কমলাপুরে ৮০ টাকা ভাড়ার একটি বাসায় উঠেন। এভাবে আরও ভালো কাজের সংগ্রামে ঘুরতে ঘুরতে একদিন হয়ে গেলেন ঢাকার সিনেমার নায়করাজ!

এই উপাধি তাঁকে অবশ্য দিয়েছিলেন স্বনামখ্যাত চিত্র সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরী। ঢাকার সিনেমার খ্যাতির চূড়ায় বসে দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছেন নায়ক রাজ। সময়ের সঙ্গে বার বার নিজেকে গড়েছেন-ভেঙ্গেছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে হয়েছিলেন ঢাকাই ছবির উত্তম কুমার। স্বাধীনতার পরে হয়ে গেলেন ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’এর মতো ছবির নায়কও হয়েছেন। তিনি ছবি প্রযোজনা পরিচালনা করেছেন।

খ্যাতির শিখরে থাকতে তাঁকে নিয়ে বানানো হলো, ‘বড় ভালো লোক ছিল’। এখনও সবাই বলেন বড় ভালো লোক ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক । ঢাকাই ফিল্মের একজন অভিভাবক ছিলেন।

তেমন একজন নায়ক তেমন একজন অভিভাবক আর করে ঢাকাই ছবি পাবে, আদৌ পাবে কিনা কেউ জানেনা।  রাজ্জাক-কবরী জুটি কলকাতার উত্তম-সূচিত্রা জুটির মতো বিপুল দর্শক প্রিয় হয়েছিল।

ববিতা-শবনম-শাবানা-সুচন্দা-সুজাতা-সুচরিতা সহ ঢাকাই ছবির সব নায়িকার সঙ্গে সুপার-ডুপার হিট ছবি সহ তাঁর ছবির সংখ্যা তিনশ’র বেশি। বার ছয়েক শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরষ্কার ছাড়াও বাংলাদেশ তাঁকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে সম্মানীত করেছে।

অতঃপর এক সময় বয়স বাড়লো রাজ্জাকের। নায়ক রাজ রাজ্জাকের জনপ্রিয়তা কমে গেল। এরমানে কমে গেল ঢাকাই ছবির জনপ্রিয়তা। অদ্যাবধি সে জনপ্রিয়তা আর ফিরে পায়নি ঢাকাই ছবি।

তাঁর পুরো নাম আব্দুর রাজ্জাক। ১৯৪২ সালে কলকাতায় জন্ম। স্কুলে থাকতে স্বরস্বতী পুজার নাটকে অভিনয় করেছেন। অনুশীলনে তার অভিনয় দেখেই তাকে নাটকের মূলচরিত্র দেয়া হয়।

সিনেমায় কাজের স্বপ্ন নিয়ে একবার মুম্বাইও গিয়েছিলেন। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হলে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী খায়রুন্নেসা লক্ষী ও বড় ছেলে বাপ্পারাজ।

শুরু হয় ঢাকায় শরণার্থী জীবন। শরণার্থী শিবিরে স্ত্রী-সন্তানকে রেখে দেখা করেন আব্দুল জব্বার খানের সঙ্গে। ইনি ঢাকার প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশের নির্মাতা।  কলকাতার পীযুষ বসু নামের একজন তাঁকে এই যোগসূত্রটি দিয়েছিলেন।

বলে দিয়েছিলেন ঢাকায় পৌঁছে আব্দুল জব্বার খান ও শব্দ গ্রাহক মনি বসুর সঙ্গে দেখা করবি। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। তারা তোকে একটা না একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবেই দেবে।  

আব্দুল জব্বার খান তাঁকে ইকবাল ফিল্মসের অফিসে একটি চাকরি ব্যবস্থা করে দেন। চাকরিটা পেয়ে তিনি কমলাপুরে একটি বাসা ভাড়া নেন আশি টাকায়। পরিচালক কামাল আহমদের সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁর সঙ্গে সহকারী পরিচালকের কাজ দেন।

কিন্তু রাজ্জাকের মন অভিনয়ে। তখন ঢাকা টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা পান। ওই সময়ে সুযোগ পান ১৩ নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন, কার বউ, আখেরি স্টেশন সহ কয়েকটি ছবির ছোট চরিত্রে।

রূপবান ছবির সাফল্যে ঢাকায় তখন লোক কাহিনী ভিত্তিক ছবি বানানোর ধুম লেগেছে। স্রোতের মধ্যে টিকে থাকার আশায় জহির রাহয়ানের মতো পরিচালক ‘বেহুলা’র মতো ছবি বানানোয় হাত দেন।

রাজ্জাককে দেখে তাঁর পছন্দ হলো। জহুরি জহর চেনে! নায়িকা সুচন্দার বিপরীতে ছবিটিতে তাঁকে প্রধান চরিত্রে সুযোগ দেন জহির রায়হান। ছবিটি ব্যবসা সফল হওয়ায় রাজ্জাকও টিকে যান সিনেমায়। আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

এরপর জহির রায়হান রাজ্জাক-সুচন্দাকে নায়ক নায়িকা করে ‘আনোয়ারা’ ও ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’ ছবি দুটি বানান। নজিবর রহমানের উপন্যাস আনোয়ারা।  ছবিতে আনোয়ারার স্বামীর ভূমিকায় দূর্দান্ত অভিনয় করেন রাজ্জাক।

বেহুলার মতো লোক কাহিনী ভিত্তিক ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’ ছবিতে রাজ্জাক এক রাখালের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো রাজকুমারের চরিত্রে অভিনয় করেন। দুটি ছবিই দর্শক প্রিয় হয়।

রূপবান ছবির সাফল্যে সুজাতা তখন  সুপার স্টার। তাঁর বিপরীতে রাজ্জাককে নায়ক করে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিটি বানান আমজাদ হোসেন ও নূরুল হক বাচ্চু। ম হামিদ বানান ‘অপরাজেয়’।

এই সময়ে আমজাদ হোসেন সুচন্দার বিপরীতে রাজ্জাককে নায়ক করে ‘জুলেখা’ ছবিটি বানান। ১৯৬৮ সালে বানান সংসার’ ছবিটি। এ ছবিতেই রাজ্জাক-সুচন্দার মেয়ের চরিত্র অভিনয় করেন ফরিদা আখতার ববিতা।

 সুচন্দার ছোট বোন ববিতার এটিই প্রথম ছবি। একই বছরে রহিম নেওয়াজ ও নুরুল হক পরিচালিত ‘দুই ভাই’ এবং নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘কুচবরন কন্যা’ ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক।

১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় রহিম নেওয়াজ পরিচালিত রাজ্জাক-সুচন্দার ছবি ‘মনের মতো বউ’। ১৯৭০ সালে অভিনয় করেন রোমান্টিক ছবি ‘যে আগুনে পুড়ি’ ছবিতে। এ ছবির পরিচালক ছিলেন আমির হোসেন।

রাজ্জাক-কবরীকে জুটি বানিয়ে ১৯৬৮ সালে সুভাষ দত্ত বানান ‘আবির্ভাব’। ঢাকা আসার পর যে আব্দুল জব্বার খান রাজ্জাককে প্রথম একটি ফিল্ম অফিসে চাকরি দিয়েছিলেন এবার তিনি তাঁকে নায়ক করে বানান ‘বাঁশরী’।

পরিচালক মোহসীন রাজ্জাককে নায়ক করে বানান গৌরী ছবিটি। ১৯৬৯ সালে রাজ্জাক-ববিতা জুটির ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। পরিচালক ছিলেন এহতেশাম।

নতুন এই জুটির জনপ্রিয়তা দেখে বাবুল চৌধুরী ‘টাকা আনা পাই’ এবং নজরুল ইসলাম ‘স্বরলিপি’ ছবি দুটি বানিয়ে সফল হন। পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বের ছবি ছিল টাকা আনা পাই।

সেই সময়ে কবরী রাজ্জাকের ময়নামতি ছবির নায়িকা হন। এটি কাজী জহিরের অন্যতম অমর ছবি। বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া বিয়োগান্তক এ ছবির ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’ গানটি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

ছবির জন্যে গানটি গেয়েছিলেন বশির আহমদ। ১৯৭০ সালে রাজ্জাককে নায়ক করে তাঁর আলোচিত রাজনৈতিক ব্যাঙ্গাত্মক ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’ বানান জহির রায়হান।

আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলের এক পরাধীন দেশের সচেতন নাগরিক ফারুকের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেন রাজ্জাক। তাঁর নায়িকা ছিলেন সুচন্দা। রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন ছবিটির গুরুত্বপূর্ন চরিত্রে অভিনয় করেন।

কিন্তু ময়নামতি ছবির বিপুল সাফল্যে তখন অনেক নির্মাতা রাজ্জাক-কবরী জুটির ছবি নির্মানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তখন এ জুটির উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল নারায়ন ঘোষ মিতার ‘অ আ ক খ’ (১৯৭০), দ্বীপ নিভে নাই(১৯৭০), নুরুল হক বাচ্চুর ‘যোগ বিয়োগ’(১৯৭০), নজরুল ইসলামের ‘দর্পচূর্ন’(১৯৭০), কামাল আহমদের ‘অধিকার’(১৯৭০), আব্দুল জব্বার খানের ‘কাঁচ কাটা হীরে’(১৯৭০), বাবুল চৌধুরীর ‘আঁকাবাঁকা’৯১৯৭০), আলমগীর কুমকুমের ‘স্মৃতিটুকু থাক’ (১৯৭১), এবং আলী কায়সারের ‘গাঁয়ের বধূ’(১৯৭১)।

 একই বছরে অশোক ঘোষের ‘নাচের পুতুল’ ছবিতে রাজ্জাকের বিপরীতে অভিনয় করেন শবনম। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মানুষের মন’ (১৯৭২) ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক-ববিতা।

মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এ ছবির বিপুল সাফল্যে রাজ্জাক-ববিতা জুটির ছবি নির্মানে ধুম পড়ে যায়। তখন অশোক ঘোষ ‘প্রিয়তমা’(১৯৭৩), কবির আনোয়ার ‘শ্লোগান’ সহ আরও কিছু ছবি বানানো হয়।

১৯৭২ সালে কাজী জহির রাজ্জাক-শাবানা-সুজাতাকে নিয়ে বানান ত্রিভুজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ মন’। ঢাকার ছবিতে কাজী জহিরের সিনেমা মানেই সুপার ডুপার হিট। তাঁর প্রতিটি ছবির নামও করা হয় পাঁচ অক্ষরে!

 অবুঝ মনের বিপুল সাফল্য ধুম পড়ে রাজ্জাক-শাবানা জুটির ছবি নির্মানে। এ জুটির ছবি নির্মিত হয়েছে চল্লিশটির বেশি। তখন তাদেরকে চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা এগারো জন’, চৌধুরী বাড়ি’, কামাল আহমদের ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’(১৯৭২), বাবুল চৌধুরীর ‘প্রতিশোধ’(১৯৭২), ইবনে মিজানের ‘কমল রানীর দিঘী’, (১৯৭২), এস এম শফির ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’(১৯৭২) নারায়ন ঘোষ মিতার ‘এরাও মানুষ’ ছবিতে দেখা যায়।

১৯৭৬ সালের সুপার ডুপার হিট হয় জহিরুল হক পরিচালিট রাজ্জাক-ববিতা জুটির ‘কি যে করি’ ছবিটি। এ ছবিতে ফাঁসির আসামী বাদশাহ চরিত্রে অভিনয় করে রাজ্জাক প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পান।

একই বছরে রাজ্জাক-কবরী জুটির ‘গুন্ডা’ ছবিটিও ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৭ সালে আজিজুর রহমানের অমর প্রেম, অশোক ঘোষের মতিমহল, আব্দুল লতিফ বাচ্চুর ‘যাদুর বাঁশি’ ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক।

১৯৭৭ সালে নিজে পরিচালকের খাতায় নাম লেখান রাজ্জাক। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবির নাম অনন্ত প্রেম। ববিতার সঙ্গে এ ছবিতে চুম্বন দৃশ্যের শুটিং এর ঘটনা হৈচৈ ফেলে দেয়। যদিও দেশের রক্ষনশীল সমাজ চিন্তায় পরে দৃশ্যটি বাদ দেয়া হয়।

১৯৭৮ সালে আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ ছবিতে স্কুলের পাহারাদার রহমত ভাইর ভূমিকায় রাজ্জাকের অভিনয় সবার মনে দাগ কাটে। ছবিতে একটি জনপ্রিয় গান ছিল, ‘মাষ্টারসাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’।

সে বছর রাজ্জাক অভিনীত দিলীপ বিশ্বাসের ‘জিঞ্জির’ ছবিটি নিয়েও তুমুল আলোচনা হয়। ১৯৮২ সালে সৈয়দ শামসুল হকের গল্প নিয়ে মহিউদ্দিন বানান ‘বড় ভালো লোক ছিল’।

ছবির ইয়াসিন চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে তিনি তৃতীয়বারের মতো জাতীয় পুরষ্কার পান। ১৯৮৩ সালে রাজ্জাক অভিনীত পরিচালিত ‘বদনাম’ ছবির গান ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও, আমিতো এখন আর নই কারও’ এখনও জনপ্রিয়।

১৯৮৪ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চন্দ্রনাথ’ উপন্যাস নাম ভূমিকায় অভিনয় করে চতুর্থবারের মতো জাতীয় পুরষ্কার পান নায়করাজ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিরহ ব্যথা উপন্যাসের নগেন্দ্রনাথ সহ অনেক অমর সাহিত্যের চরিত্রগুলোয় অভিনয় করে রাজ্জাক অমর হয়ে আছেন।