আমার এ লেখার শিরোনামটি দেখে অনেকে চমকে যেতে পারেন। বিরক্তও হতে পারেন। আমি আমার লেখার প্রশ্নে যুক্তি দেবো। মুখে না বললেও ভারতের আসাম ভিত্তিক আলোচিত নাগরিকত্ব আইন এনআরসির টাইম ফ্রেমেই বলে দেয়া হয়েছে চিহ্নিতদের সিংহভাগ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া লোক। টাইম ফ্রেমটি হলো ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতে যারা শরণার্থী হিসাবে যায় এবং দেশ স্বাধীন হবার পর তাদের প্রায় সবাই ফিরেও আসে। কিন্তু সব যে আসেননি, আমি আপনি স্বীকার করি বা না করি তা সত্য। কুলাউড়ার উত্তরবাজারের কালা চাঁদ পাল কি ফিরেছেন? না ফেরেননি। কালা চাঁদ পালের সঙ্গে আমার ভারতে দেখা হয়েছে। আমাকে তিনি বলেছেন একদিনতো আসতেই হতো। কারন সব সহ্য করতে পারি। মালাউন বলে গালি দিলে অসহ্য লাগে। বাংলাদেশের এলাকায় এলাকায় এমন অসংখ্য কালা চাঁদ পালের নজির আছে। আমার নমস্কার বাংলাদেশ’ বইতে এমন একটি দেশান্তরী পরিবারের গল্প আছে। নানা অনিশ্চয়তা হতাশায় বাংলাদেশের হিন্দুরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। কিন্তু ওখানেও তাদের সবাই ভালো থাকেনা। জন্মভূমির জন্যে সারাক্ষন তাদের প্রানপুড়ে। কিন্তু ফিরতেও পারেনা। বেশি অসহ্য বোধ হলে মাঝে মাঝে সীমান্তে এসে হাত জোড় করে জন্মভূমিকে নমস্কার প্রণাম জানিয়ে চলে যায়।
এবার ভারতও চিহ্নিত করেছে আসামে তাদের ভাষার বিদেশিদের সিংহভাগ হিন্দু। নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সব সময় ভারতে চলে যায় এটি ওপেন সিক্রেট বিষয়। জমিজমা দখল করার জন্যেও বাংলাদেশের প্রভাবশালীরা হিন্দুদের সীমান্ত পার করে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে ফরিদপুরে সাবেক এক মন্ত্রীও তাই করেছেন। এখন আবার জানা যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেও নতুন করে পাহাড়িরা বিশেষ করে যুবকরা চুপচাপ ভারতে চলে যাচ্ছে। শান্তি চুক্তির এতো বছর পরে এসেও পাহাড়িরা পাহাড়ে নিজেদের নিরাপদ বোধ করছেননা কেনো এর জবাব বাংলাদেশকেই খুঁজতে হবে। আসামে এনআরসিতে নাগরিকত্ব সংকটে পড়া বেশিরভাগ হিন্দু চিহ্নিত হওয়ায় পুরো পর্বটি তাদের জন্যে আপাতত বুমেরাংও হয়েছে। কারন আসামের বিজেপি সরকারের বিদেশি চিহ্নিত করার মূল মোটিভটি ছিল রাজ্যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমান চিহ্নিত করা।
বাংলাদেশের আরেকটা বিষয় আগাম বিবেচনায় রাখা উচিত। তাহলো ভারতের এই এনআরসি শুধু আসাম রাজ্য ভিত্তিক কার্যক্রম নয়। আগামীতে এটি ভারতের রাজ্যে রাজ্যে গড়াবে। এটিই বিজেপির নির্বাচনী অঙ্গিকার। বিজেপি বুঝে গেছে এরসব বললে করলে তাদের ভোট বাড়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন উদার ধর্ম নিরপেক্ষ মানবতাবাদী ভারত আর আজকের ভারত এক না। আরকটু কাঁচাছোলা ভাষায় বললে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নরেন্দ্র মোদী আর এই বিজেপি যদি ক্ষমতায় থাকতো তাহলে বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় পেতোনা।
আসাম এনআরসিতে চিহ্নিত বিদেশি তথা বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভবিষ্যত নিয়েও আমি চিন্তিত নই। কারন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে যাওয়া হিন্দুদের আশ্রয় দেয়া নিয়ে দেশটির একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে। এখন ভারত মুখে যতই বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরীন বিষয় বলুকনা কেনো এক পর্যায়ে সমস্যা হবে বিদেশি চিহ্নিত মুসলমানদের নিয়ে। আমার কাছে এরা গরিব মানুষ। ঘর-সহায় সম্বল ভাগ্যহীন নদী ভাঙ্গা মানুষ। গরিব মানুষজনের কাছে আবার কী দেশ কী সীমান্ত।
এমন গরিব মানুষজনকেইতো সরকারি উদ্যোগে এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের যাদের সামর্থ্য আছে কাজের-উন্নত জীবনের আশায় তারা আরব আমিরাত-মালয়েশিয়ার মতো বিভিন্ন দেশে যায়। নানান চোরাইপথে ইউরোপের উদ্দেশে যায় লিবিয়া-সাইপ্রাস-তুরস্ক বা গ্রীসে। যাদের সামর্থ্য নেই তারা চলে আসে ঢাকা-চট্টগ্রামের বস্তিতে। সীমান্ত এলাকার গরিব লোকজনের এক সময় আরও সহজ ছিল সীমান্ত পেরিয়ে ভারত চলে যাওয়া। ঢাকাও তাদের কাছে বহুদূর। বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া দেয়াতে এখন এ পথটি আগের মতো আর সহজ নয়। বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘ পুরো সীমান্ত এখনও কাঁটাতারের বেড়ার আওতায় আসেনি। যারা যেতে চাইবেই বেড়া তাদের কী আটকাতে পারে? আর বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের ভারতীয় দাবিটিও বেশ পুরনো।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর ভারত থেকে পুশইন সমস্যা শুরু হয়। দিল্লীর বিভিন্ন বস্তিতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ বাংলাদেশিদের ধরে ট্রেনে করে সীমান্তে নিয়ে এসে পুশইন করা হয়। বাংলাদেশ তখনও উচ্চকন্ঠে বলছিল এরা বাংলাদেশি না। ভারত জোর করে তাদের বাংলাভাষী নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতের পুশইন ঠেকাতে সীমান্তে তখনকার বিডিআর প্রহরা বাড়ানো হয়। ভারতের ঠেলে দেয়া লোকজন সীমান্তের জিরো পয়েন্টে কয়েকদিন রোদে পুড়ছিল বৃষ্টিতে ভিজছিল। সীমান্তে তখন সরেজমিন রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম। জিরো পয়েন্টে গিয়ে তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বললাম বিএসএফকে অনুরোধ করে তাদের আবার ভারতে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করবো কিনা। তারা তখন অকপটে বলে নারে ভাই। কাজ করতে গিয়েছিলাম। ওরা যখন ধরে ফেরত পাঠিয়ে দিলো এখন আমরা যার যার বাড়িতে চলে যেতে চাই। এদের বেশিরভাগের বাড়ি ছিল খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে। দেশের মানুষ যখন অন্য ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো রাতের আঁধারে এরা ঢুকে গেলো বাংলাদেশে, ফিরে গেলো যার যার গ্রামে। এভাবে তখন পুশইন করা বাংলাদেশিদের কেউ ভারত ফিরে যায়নি।
এখন ভারতীয় এনআরসির শিকার হয়ে কোন বাংলাদেশি যদি দেশে ফেরত আসতে সীমান্তে আসে তাকে বা তাদেরকে গ্রহনেও বাংলাদেশের প্রস্তুত থাকা উচিত। খালেদা জিয়ার সময়কার মতো গরিব বাংলাদেশিদের গ্রহনে রাষ্ট্র ফের নিষ্ঠুর ভূমিকা না নেয়। বাংলাদেশকে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে যাতে তার কোন নাগরিক ভারতে বা অন্যকোন দেশে চলে না যায়। আমার বিশ্বাস ভারতীয় জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া আদি বাংলাদেশিরা হয়তো ওখানেই যে কোন মূল্যে থেকে যাবার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সব সম্ভাবনা না’ হয়ে গেলেতো কিছুই করার নেই। আমি রোহিঙ্গাদের রাখতে চাইনা। ভারত কেনো আমার দেশের মানুষ রাখতে চাইবে।
গত সাত বছর ধরে আরব আমিরাতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ রয়েছে। কিন্তু অবৈধপথেশ্রমিক যাওয়া বন্ধ হয়নি। দালালরা এখন এদেরকে ভিজিট ভিসায় নিয়ে যায়। এরা হয়ে যায় অবৈধ শ্রমিক। এমন হাজার হাজার বাংলাদেশি সেখানে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। লোভী বাংলাদেশিরাই সেখানে এদের দিয়ে কাজ করিয়ে মজুরি দেয় না। মজুরি চাইলে পুলিশের ভয় দেখায়। আগে এদের পুলিশ ধরলে মিসকিন বললে ছেড়ে দিতো। এখন পাঠায় জেলখানায়। এরপর বাংলাদেশে। পধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশটিতে সর্বশেষ সফরের সময় শ্রম বাজারটি আবার খুলে যাচ্ছে বলে নিউজ করানো হয়েছিল। কেনো খুললোনা সে ফলোআপ নিউজটি কেউ করলোনা। সৌদি আরব-মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। নানা অভিযানে তাদেরকে ধরে দেশে ফেরত পাঠিয়ে যাওয়া নিত্যদিনের ঘটনা। শাহজালাল বিমান বন্দরে প্রায় প্রতিদিনই এমন ডিপোর্টেড লোকজন আসেন। অনেকে দেশে ফেরত আসেন দেশগুলোর সরকারের সাধারন ক্ষমার সুযোগ নিয়েও । এসব বাংলাদেশের অনেকটা গা-সওয়া বিষয়। ভারত প্রসঙ্গ এলেই নানান লোকজনের কাছে বিষয়টি হয়ে যায় নানামুখি স্পর্শকাতর।
স্থায়ীভাবে থাকতে অবৈধভাবে যারা ভারত চলে যান বা বৈধভাবে গিয়ে আর আসেননা, তাদের চালাক চতুররা সেখানে আধার কার্ড সহ বৈধতার নানা কাগজপত্র করে নেন। কারন বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাবার মতো ভারতের আধার কার্ড সহ নানাকিছুতেও দূর্নীতি আছে। খাগড়াছড়িতে যেমন আসাম বস্তি নামের জনপদ আছে আসামেও তেমন আছে রিফুজি বস্তি সহ নানান জনপদ। বাংলাদেশি গরিব বোকাসোকারা এখানে থাকতেও কিছু করতে পারেননি, ওখানে গিয়েও একই কারনে ধরা পড়েছেন এনআরসির ফাঁদে। বলতে পারেন কেউ গিয়ে থাকলে সেওতো তিরিশ চল্লিশ বছরের বিষয়। ওখানে তাদের বাচ্চাকাচ্চার জন্ম হয়েছে, তারা বড় হয়েছে। কিন্তু নাগরিকত্বের আইনানুগ কাগজপত্র ছাড়াতো বক্তৃতাবাজি অর্থহীন। আমার ধারনা চানক্য কূটনীতিবাজরা এখন মুখে যাই বলুক তাদের চেহারা ঘোরাতে সময় লাগবেনা। এই সরকারও দেশে অনন্তকাল থাকবেনা। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় যখন এনআরসি কার্যক্রম শুরু হবে তা হবে বেশি স্পর্শকাতর। কারন বাংলাদেশের হিন্দুরা যারা ভারতে যায় তারা এ রাজ্য দুটিতেই বেশি যায়।
আসামের এনআরসি কার্যক্রম শুরুর পর পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে বেশ হৈহৈ করতে দেখা গিয়েছিল। বলেছিলেন, এমন চিহ্নিত সবাইকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যাবেন। এখন কিন্তু মমতা গভীর চুপ। মুখে কোন কথা নেই। কারন তিনিও ভোট বুঝে গেছেন। বিজেপির গরম হাওয়া তার কান বরাবর যাচ্ছে। গদি ধরে রাখতে দিদি আর কোন ঝুঁকিতে যেতে নারাজ। আসাম এনআরসির রাতে বাংলাদেশের নানা টিভি চ্যানেল যে সব ভারতীয় সাংবাদিককে ফোনে বা স্কাইপেতে সংযুক্ত করেছিল তাদের সঙ্গে বাহাস শুনে দেখে আবার বুঝেছি ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ। কোন একজন সাংবাদিককেও ভারতের বিরুদ্ধে একটি শব্দ বলানো যায়নি। আর বাংলাদেশিরা সুযোগ পেলে শুধু বিদেশে গিয়ে নয় ঢাকার বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে অথবা তাদের পার্টিতে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে যত ফিরিস্তি অভিযোগ করা সম্ভব সবই বলে। এক চ্যানেলে এক ভারতীয় সাংবাদিক বললেন এনআরসির শিকার রাষ্ট্রহীনদের ভারত নাকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যেতে সহায়তা করবে! দাদাবাবুর কথা শুনে হাসি পেলো। যেখানে প্রতি বছর বিস্তর ভারতীয় ইউরোপের দেশগুলোতে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চায় তারা করবে বাংলাদেশির আশ্রয়ের ব্যবস্থা? আজকের ভারত অত ভালো মানুষ রাষ্ট্র হলেতো ভারতেই তাদের নাগরিকত্বের সুরাহা করতে পারতো।
এক সত্যি ঘটনা বলে এই ভারতীয় সাংবাদিকের বক্তব্যের জবাব দেই। একবার ভারতের গুজরাটের এক দম্পতি অস্ট্রেলিয়ায় এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনে বিবাহিত মেয়েটি দাবি করে সে লেসবিহান। তার পরিবার তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। এ জীবন তার ভালো লাগেনা। অস্ট্রেলিয়ায় এসে এমন গল্প যারা বলে এদেশের কর্তৃপক্ষ তাদের গল্পের সত্যমিথ্যা নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত করে। অভিবাসন দপ্তর পরবর্তী সিটিং’এ বিয়ের পর এরা যে ব্যাংককে হানিমুনে গিয়েছিল সে ছবিগুলো রাখে টেবিলে। চালাক চতুর মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে হানিমুনের তথ্য সঠিক। তার স্বামী ছেলেটি খুব ভালো একজন মানুষ। তাকে চেঞ্জ করার চেষ্টায় বিয়ের পর তাকে হানিমুনে ব্যাংকক নিয়ে যায়। কিন্তু সেতো জাত লেসবিহান। এটাতো সে চেঞ্জ করাতে পারেনা। অভিবাসন দপ্তরের কর্মকর্তা মেয়েটিকে বলেন আচ্ছা মনে করো তোমার কথা সত্য মনে করে তোমাকে প্রটেকশন দিলাম। তখন তোমার স্বামী ছেলেটির কী গতি হবে। মেয়েটি জবাব দিয়ে বলে তখন সে যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখি হয় তাতেই আমি সুখি। তৃতীয় বৈঠকে মেয়েটি কাঁপতে শুরু করে। অভিবাসন কর্মকর্তা দেশে রেখে আসা তার শিশু সন্তানকে ভিডিও কলে সংযুক্ত করে জানতে চান এটি কার বাচ্চা? খুব স্বাভাবিক তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।