এশার নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছি৷ সূরা ফাতিহার পর মনের অজান্তেই একটি সূরা মিলালাম, যার নাম সূরাতুল যিলযাল৷ আট আয়াত বিশিষ্ট ছোট্ট একটি মাদানী সূরা৷ যখন তিলাওয়াত শুরু করলাম তখন শরীরে হঠাৎ ই একটা অজানা ভীতির শিহরণ জাগরিত হল৷ প্রান্তসীমায় ক্ষান্তকর্মের ডাক অনুভূত হল৷ কঠিন হৃদয় যেন মোমের ন্যায় বিগলিত, অন্ধকারে পূর্ণ আত্মা যেন পুরোটাই শূন্য, লোভাতুর চাহনী যেন আজ দৃষ্টিকটুর পাত্র৷
অপূর্ব সুন্দর এই পৃথিবীতে চিরদিন বেঁচে থাকার পূর্ণ স্বাদ, বাসনা, আকাংখা আমার হৃদয়পটে অঙ্কিত হয়ে আছে৷ চাইলেও আমি তা দূর করতে পারছি না৷ সময়ের গতিপথে, স্রোতের অনুকূলে, প্রতিযোগীতার অন্তরালে কতই না স্বপ্নবীজ বুনে পরকালের কথা বেমালুম হয়ে গিয়েছি৷ অস্থায়ী রাজ্যে সফলতার বিপরীতে চিরস্থায়ী স্বর্গরাজ্যকে গুরুত্বহীন করে রেখেছি৷ ব্রহ্মাণ্ডের আবর্তনে বিজ্ঞানের মোহে পড়ে ঐশী বাণীকে কতই না তুচ্ছজ্ঞান করেছি অথচ যেটা ছিল আসমানি কিতাবের প্রতিবিম্ব মাত্র৷
মহান রবের দিকনির্দেশিকা পবিত্র কুরআনের হুকুম-আহকাম ত্যাগ করে আজ মানবরচিত বাণীতে আমার কর্ণকুহর পরিপূর্ণ, হৃদাঙ্গনে সেটার আবাদ করে তুলছি দিনের পর দিন৷
আবশ্যিক (ফরজ) বিষয় পরিত্যাগ করে আজ অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের বিষয়গুলোর প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছি খুব বেশি৷ সামান্য বিষয়ে তর্ক-বিতর্কের উত্থান যেন পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, উদার হৃদয় যেন আজ হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকারের আবাসভূমি৷ সুন্দর হৃদয় পরিণত হয়েছে কুৎসিত কাঁটাযুক্ত বিষবৃক্ষে৷ যেটা ছিল এই বাহ্যিক রূপে-গুণে পরিপূর্ণ সুন্দর ধরণীর কদাকার চাহনীর কলুষিত আত্মার প্রতিধ্বনি মাত্র৷
এত শত লোভ-লালসা, আকাংখার উপাদানে ভরা অস্থায়ী জমিন যখন আমাকে অস্বিকার করবে, আমার ধনদৌলতকে পিষ্ট করে দিবে, আমার বসবাসের অট্টালিকাকে ভূ-গর্ভে বিলিন করে দিবে৷ এত চিত্তাকর্ষণ গাছ-গাছালি, তরুলতা, নদী-নালা, সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত প্রভৃতি যখন ধূলির ন্যায় উড়তে থাকবে৷ শিঙ্গায় ফুঁৎকারের ধ্বনি যখন প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে, সেই সময়টা (কেয়ামত) কতটা ভয়ংকরী ও বিভৎসময়ী চেহারায় রূপ নিবে সেটা কি আমি একটিবারের জন্যও ভেবে দেখেছি? চিন্তা করার ফুসরত পেয়েছি কখনো এসব নিয়ে? নাকি শুধু ছুটছি আর ছুটছি অস্থায়ী সফলতার পিছনে!
কথায় কর্মে মানুষের অন্তরে আঘাত করা, কারো অধিকার খর্ব করা, সামান্য অজুহাতে স্রষ্টার বিধান লংঘন করা এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অথচ সেদিন (কিয়ামতের দিন) পৃথিবী তার কলিজার টুকরা বিশালাকার স্বর্ণ খন্ডের আকারে উদগীরণ করে দেবে৷ তখন যে ব্যক্তি ধন-সম্পদের জন্যে কাউকে হত্যা করেছিল সে তা দেখে বলবে, এর জন্যেই কি আমি এতবড় অপরাধ করেছিলাম? যে ব্যক্তি অর্থের কারনে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল সে বলবে, এর জন্যেই কি আমি এ কাণ্ড করেছিলাম? চুরির কারনে যার হাত কাটা হয়েছিল সে বলবে, এর জন্যেই কি আমি নিজের হাত হারিয়েছিলাম? অতঃপর কেউ এসব স্বর্ণখণ্ডের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবে না৷
“সেদিন যে কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করবে সে তার প্রতিদান পাবে আর যে কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করবে সেও তার প্রতিদান পাবে৷”
এসব ভাবনা চিন্তার আদলে আমার হৃদয় যখন অন্তঃসারশূন্য, অন্ধকার গুহায় নিমজ্জিত৷ তখন সেই পাপে কলুষিত দেহযষ্টি নিয়ে, অনুতপ্ত হৃদয়ে নামাজান্তে প্রভুর দরবারে একটাই মিনতি করলাম-
“কত স্বপ্ন করেছি লালন
পরিত্যাগ করেছি শত বিধান,
কোন মুখে আমি চাহিব ক্ষমা
পুণ্যবিনা জীবন এই শূন্য অভিধান৷
প্রভু হে নতশিরে মিনতি দরবারে তোমার,
অস্থায়ী ভুবনে কষ্টে যাতনা পেতে
রাজি হাজারবার
তবু যেন পরকালে বিদ্যুৎবেগে
পুলসিরাত হই পার৷”
★তথ্যসূত্রঃ
তাফসীরে কানযুল ঈমান
তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন
দেওয়ান মোঃ ছাইফুদ্দিন৷ বাবার নাম মাওঃ ছালাহউদ্দিন দেওয়ান ও মায়ের নাম ছালেহা খাতুন৷ চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলা, ফরক্কাবাদ গুলিশা গ্রামের দেওয়ান বংশের সন্তান৷ বর্তমানে অনার্স করছেন চাঁদপুর সরকারী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে৷ ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি কবিতা, গজল-সংগীত ও আর্টিক্যাল লেখার প্রতি বেশ ভালোলাগা কাজ করে৷ বলতে গেলে, বরাবরই বাংলা সাহিত্যের প্রতি একটা ঝোঁক রয়েছে তার৷