নিজের অনুভূতি

বসে আছি কোনো এক জলাশয়ের কাছে৷ ছোট-বড় গাছ-গাছালি আর ক্ষুদ্র লতাপাতা দিয়ে ঘেরা চারদিক৷ বেশ শুনশান জায়গা, ভালো লাগছিল আমার৷ এরই মধ্যে মনে হল জলাশয়ে নেমে একটু স্নান করে নেই৷ যেই ভাবা সেই কাজ! কিছুদূর নেমে হাতের অঞ্জলি দিয়ে পানি ঢালছিলাম শরীরে৷ নাকে একটা উদ্ভট গন্ধ লাগছিল, তাকিয়ে দেখি ঘোলাপূর্ণ জল, শ্যাওলা আবৃত৷ সে কি এতক্ষণ খেয়াল করিনি এসব! ধুর ছাই!
সাথে সাথে উঠে গেলাম, পাশের আরেকটি পুকুরে গিয়ে স্বচ্ছ পানিতে গোসল সেরে নিলাম৷

হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গে আব্বুর কর্কশ স্বরে৷ বিছানায় শুয়ে আছি৷ গায়ে হাত দিয়ে দেখি সব শুকনো, কোথাও ভেজা নেই৷ তাহলে দু’ দু’বার গোসল করলাম যে! সেটা কি হবে! হুঁশ ফিরে এলো৷ বুঝতে বাকি রইল না যে এটা একটা নিছক স্বপ্ন ছিল মাত্র৷

হুড়মুড় করে উঠে দেখি সাড়ে নয়টা বাজে৷ দরজা খুলে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখলাম আব্বু লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ‘সকালটাই মন্দ’ ভাবলাম এই মারবে বুঝি আমাকে৷ কিন্তু না!

বলল তাড়াতাড়ি আয়, হাঁস আনতে হবে পুকুর থেকে৷ বুঝলাম আমার কপালে মাইর না থাকলেও হাঁসের কপালে ঠিকই আছে৷

গতকাল থেকেই আমাদের হাঁসগুলোর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না, আজ সকালে দূরে এক পুকুরে হাসের সন্ধান পাওয়ায় আব্বু আর আমি তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে পড়লাম৷ পুকুর না ঠিক, গ্রাম্য ভাষায় ডোবা বলা চলে৷ পানি একেবারেই কম ছিল, হাঁটুর নিচ পরিমাণ৷ বর্ষার আগমনের পূর্বে জলাশয়গুলোতে যা হয় আরকি৷

আমিই নেমে পড়লাম আগেভাগে৷ মোটামুটি হৈ-হুল্লোড় করে অবশেষে কিনারে আনলাম হাঁসগুলো৷ উফ বাঁচা গেল! এই ভাবতে ভাবতে ডোবার যখন ঠিক মাঝখানে এসে পড়লাম ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম৷ চারদিকে ক্ষুদ্র কচুরীপানা ঘিরে থাকার কারনে বড় একটা গর্ত লক্ষ্যই করিনি৷ কি আর করার, গোসল করিয়ে ছাড়ল৷ বাড়িতে এসে লুঙ্গি আর গামছা হাতে নিয়ে ভোঁ-দৌড় পুকুরের দিকে৷ দ্বিতীয়বারের মত গোসল সেরে নিলাম৷ তখনো কিন্তু স্বপ্নের কথা দিব্যি মনে নেই৷

ঘরে এসে বিশ্রাম নিতে নিতে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল কপালে৷ এটা তো একটা স্বপ্নের বাস্তব রূপ৷ শুনেছি সকালের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, আমার বেলায়ও তাই হল৷ মনে মনে স্বপ্নের একটি সংজ্ঞা অংকন করলাম তা হল, বাস্তব জীবনরেখার কাল্পনিক একটি সংকেতই স্বপ্ন, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে৷

অনেক সময় স্বপ্ন আমাদেরকে কিছু সংকেত দেয়, মেসেজ দেয়, যা বাস্তবে ঘটতে যাচ্ছে এমন৷ আবার কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলো শুধুমাত্র স্বপ্ন নয় বরং আমরা বাস্তবেই দেখতে পাই কিন্তু তা আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দেয় না৷ ভবিষ্যতে কি হবে, কি ঘটতে যাচ্ছে আমার সাথে! এসব বিষয়ে চিন্তার ফুসরত পাই না৷ এসব অতি বাস্তব, অতি সত্য, অতি চিরায়ত৷ তন্মধ্যে একটি হচ্ছে- মৃত্যু৷

কোনো চিন্তা, কোনো গবেষণা এটাকে নিশ্চয়তা দিতে পারেনা যে কবে কার সাথে ঘটতে যাচ্ছে৷ তবে সকলে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারে যে, একদিন ঘটবেই৷ এটা চিরায়ত সত্য৷ প্রতিদিন আমরা কারো না কারো মৃত্যুর খবর শুনি, তাকে শেষ গোসল দেই, কাফন পড়াই, জানাজা পড়ি, মাটিচাপা দেই৷ যাকে আমি বাবা বাবা বলে ডাকি তিনি আজকে আমার কথায় সাড়া দেন না৷ যেই মা আমায় এত আদর-স্নেহ করতেন, আজ তাকে হাজারবার ডাকলেও সাড়া দেন না৷ যেই ভাই আমাকে ছায়া করে রাখত, আজ সেই ছায়াটি নেই৷ যেই বোন আমাকে সবসময় আগলে রেখেছে, বিপদে সান্তনা দিয়েছে, আজ সান্তনা দেয়ার মত কেউ রইল না৷ পাশাপাশি বসে চায়ের কাপে ঝড় তুলে কত আড্ডা দিয়েছি যে বন্ধু মিলে, আজ পাশের জায়গাটি শূন্য৷ এভাবেই হারিয়ে যাব কোনো একদিন আমিও, কোলাহল ঠিকই রবে যদিওবা একটুখানি জায়গা খালি থাকবে৷

এতদ্বসত্ত্বেও এমন কিছু করে বিদায় নেয়া দরকার, এমন কিছু রেখে যাওয়া উচিত, যা আমাদেরকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে, বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের স্মৃতিটুকু৷

মানুষের অন্তরে দুইভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকা যায়৷ একটা হল কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে, দ্বিতীয়টা হল ভালোবাসার মাধ্যমে৷ এ দু’জিনিস মানুষের অন্তরে সবসময় আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং পরকালের হিসাব-নিকাশের মানদন্ড হবে এগুলো৷ তাই আমরা যেন এমনভাবে মারা না যাই যে, মানুষ বলবে সে বড় খারাপ মানুষ ছিল, সে মরে আমাদেরকে বাঁচিয়ে গেছে৷ এমন যেন আমরা না হই৷ বরং আমরা যেন এমন হই যে, আমরা মারা যাওয়ার পর মানুষ বলবে- সে বড় ভালো মানুষ ছিল, সে বড় দয়ালু ছিল৷

কথায়- কাজে প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষের অন্তরকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিতে হবে আমাদের, সেই লক্ষ্য পূর্ণ করে চিরবিদায় নিতে হবে৷ তাহলেই ক্ষুদ্র ক্ষণস্থায়ী এই জীবন সার্থক হবে৷ পরিশেষে কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই,

যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে
কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিল সবে৷
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন৷