১১ই মার্চের পর থেকে আমাদের বেঁচে থাকা, প্রত্যেকটি ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে। এভাবেই কাটছে জীবন গুলো অবসাদে আর চিন্তাকাতরতায়। আজ আমাদের হোটেল কোয়ারেন্টাইনের সপ্তমদিন। বন্ধ দরজার ভেতরে আমাদের দুরুমের সংসারই বলা যায়। সব কাজই করতে হচ্ছে শুধু রান্নাটা বাদে . তবে মন পছন্দ খাবারের মেনু দেখে অর্ডার করার যো নেই। যা দেবে সরকার তাই খেতে হবে।আদরের ভেতরে আমাদের এখন ক্লোরোফিলহীন হলুদ পুস্পিত মুখ, কখনো কখনো নি:শব্দ, হোটেলের হুল্লোর, ওয়াইনের বোতলের টুংটাং ফেটে পড়া অট্টহাসি বড্ড মিস করছি। ভেতরে ভেতরে আমাদের কষ্টের অসভ্য চিৎকার গুলো কেবল আমরাই শুনতে পাচ্ছি রোজ খাঁকি প্যাকেটে দুধ, জুস, পুডিং, কেক, স্যালাড, পাস্তা,ফলের সাথে রাগ অভিমান ভাগাভাগি করছি। যাদের সাথে জমে যাচ্ছে তাকে রেখে দিচ্ছি যত্নে, আর যাদের সাথে জমছে না ঠিকঠাক, তাদেরকে খাকি প্যাকেটে পুড়ে বাইরে রেখে আসছি। আমাদের একা হয়ে যাওয়ার মাতলামি, সব সয়ে যখন আমাদের করোনা বিপ্লবের জানুভাঙ্গা ক্রোধ সবর্স্ব অস্থির কন্ঠস্বর, নিয়ে ফিরবো ঘরে সেখানেও একই অবস্থা আরও কিছুদিন। কেউ আসবে না আমিও যাবো না, কেউ আসছে জেনে তোড়জোড় করে বিরিয়ানি দমে বসাবো না, ভাবতেই কেমন যেন বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে।, সব সময় কেবল একটা চিন্তাই মাথায় ঘোরে, কবে পৃথিবীর অসুখ সারবে। শোরগোল করে মেতে উঠবে বসার ঘর। মন উদাস হলে যখন ভাবছি আর ছুটে যেতে পারবো না মাউন্ট লফ্টির উঁচু পাহাড়ে, তখন খুব খুব কান্না পাচ্ছে। কেবলি অপেক্ষা করছি আমার মেয়েরা আবার কবে ফুল্লতাখচিত পাখা জাগিয়ে উড়ে ওঠা প্রজাপতির নাচ দেখবার জন্য
ছুটে যাবে ফুল বাগানে।
যেই না হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুবে দু কদম – ওরা, সাবধানে মা সাবধানে যাও, ওদের এমন সাবধানতায় অামার নিজস্ব কিছু অঙ্গ যা ছুঁয়ে দেখতেও সাবধানী হবো বোধ হয়, এমন সংকট কালে। প্রতিদিন দুচোখ মেলে জানালার ওপাড়ে দৃষ্টি ফেলি, দীর্ঘ সম্ভাবনায় দৃষ্টি, ভাবি এমন বিবতর্নে কি আর পাল্টাবে মানুষের চৈতন্যে। এই একলা থাকার মাঝে যে আমি নিজের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছি, তাকে যেন তার স্রষ্টা চেনে।
আমি যেন মনে মনে আবার পাখি হোলাম স্বপ্নে গতরাতে। ঘড়ির ভেতর উড়তে থাকা ঘড়ির পাখি, চতুর্মাত্রিকতার ঘড়ি। তিনটি আকাশ, একটি সময়, একটি পাখি।
সময় – কি করে আমাদের তুমি দাঁড় করালে, জীবানু বিপ্লবের সামনে। আমারদের অশ্রুর প্রশ্ন গুলো পৃথিবীর দিকে মুখ করা, আর ভেতরের দিকে মুখ ঘোড়ানো। শুনেছিলাম ভেতরে ক্ষরণ না হলে, কোন কিছু সৃষ্টি করা যায় না। কে কতটা সৃষ্টি করছে আমি জানি না, কিন্তু আমার দ্বারা যেন কিছুই হচ্ছে না। শুধু একটা প্রশ্ন গুমড়ে গুমড়ে প্রকৃতিকে জিজ্ঞেস করছি আচ্ছা পৃথিবীর রোগ কবে সারবে বলতে পারো ?
যারা আমাকে ফোন করে বলছেন, ও হো ! দিব্বি আছো তোমরা ! আসলে আমরা যে যার জায়গা থেকে কেউই দিব্বি নেই। ভাবুনতো মানষিক অবস্থা গুলো, কোথায় যেন শুনেছিলাম, একজন স্বাভাবিক মানুষকে যদি তালা বন্ধ ঘরে রাখা হয়, সেই মানুষটির বেশী দিন লাগবে না
পাগল হয়ে যেতে।
আমাদেরও মনে হয় কদিন পর পাগল হবার দশা হবে।
গতরাতে একটুও ঘুমোতে পারি নি, সেহেরীর পর ঠাঁয় বসে ছিলাম জানালার পাশে। ভাবনা গুলো কেমন যেন অগোছালো … কত কত মুখ চোখের সামলে নিয়ে এলাম, কত স্মৃতি, না কিছুতেই যেন হাসি এলো না। বুঝলাম বিষাদ বড় সংক্রামক।
বিষাদ ছুঁয়েছে তাই মুখের হাসি এখন কোয়ারেন্টাইনে।
আজ খুব ঝাল ঝাল কিছু খেতে মন চাইছে। আর কত পাস্তা ভাস্তা, রুটি পেষ্ট্রি, পাতা ফল, আমার খুব মাছ ভাত খেতে মন চাইছে। মানুষের চাওয়ার শেষ নেই, ঘর ভরা খাবার, কিন্তু তৃপ্তির ঢেঁকুর লুকিয়ে আছে বাঙ্গালীর মাছে ভাতে।
দার্শনিক বোধ তাড়িত সময় সচেতন নিষ্ঠাবান কবি। চলমান বাস্তবতাকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরায় জারিত করে তিনি কাব্য রূপান্তরে অভ্যস্ত। কাব্য রচনার পাশাপাশি ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী মৌলিক গবেষণা ও কথাসাহিত্য সাধনায় তাঁর নিবেদন উল্লেখ করার মতো। গবেষণাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্যঃ জারিগানের আসরে “বিষাদ-সিন্ধু” আত্তীকরণ ও পরিবেশন পদ্ধতি শীর্ষক গ্রন্থের জন্য সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১২ অর্জন করেছেন।