অনলাইনে হুমায়ুন আজাদের ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটার রিভিউ পড়েই অনলাইনে খুঁজে একটা পিডিএফ কপি পেয়ে গেলাম। অফিসের কাজ সেদিনকার মতো মাথায় উঠল। দুটো মনিটরের ছোটটাতে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না খোলা রেখে অন্যটাতে কাজের ভান করলাম কিন্তু আমার মন পড়ে রইল বইটার পাতায়। এক দিনেই শেষ করে ফেললাম। বহুদিন বাদে একটা বই এক বসাতেই শেষ করলাম। অবশ্য বইয়ের আকার ছোট, সেটাও একটা কারণ; কিন্তু মূল কারণ হচ্ছে লেখকের শৈশব–কৈশোরের দিনগুলোর সঙ্গে আমার নিজের শৈশব–কৈশোরের দিনগুলোর অদ্ভুত মিল। আমাদের প্রজন্মও লেখকের শৈশব–কৈশোরের কিছুটা হলেও ছোঁয়া পেয়েছিলাম; বিশেষ করে আমরা যারা একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে বেড়ে উঠেছিলাম। ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না পাঠককে আবারও তার শৈশবের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে নিশ্চিত।
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না বইটাতে আছে ১৭টি অনুচ্ছেদ। প্রতিটি অনুচ্ছেদেই গ্রাম–বাংলার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একেকটা বিষয় উঠে এসেছে আর লেখকের প্রাঞ্জল বর্ণনায় সেটা হয়ে উঠেছে জীবন্ত। লেখকের বর্ণনার সবচেয়ে উপভোগ্য দিক হচ্ছে বিশেষণগুলোর ব্যবহার। গ্রামের প্রতিটি সৌন্দর্যকে একেকটা বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যেটা কিছুক্ষণের জন্য হলেও পাঠককে ভাবাবে। আর স্থানীয় শব্দগুলোর প্রয়োগ সেখানে দিয়েছে অন্য মাত্রা, যাতে সহজেই তখনকার দিনের জীবনযাত্রার ধরন টের পাওয়া যায়। প্রবাসীদের কাছে এগুলো আরও বেশি মাত্রায় ধরা দেয়; কারণ, প্রত্যেক প্রবাসীই নিজের মনের গহিন কোণে দেশকে লালন করে চলেন।
বইটা শুরু হয়েছে লেখকের কন্যা মৌলির উদ্দেশে। আমার ধারণা, লেখক ইচ্ছাকৃতভাবেই এটা করেছেন। অবশ্য এরপরেই কারণটাও বলে দিচ্ছেন। লেখকের ভাষায়, ‘মৌলি, তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি একসময় ছিলাম—ছোট। ছিলাম গ্রামে, গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে। শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো।’ এর কিছুক্ষণ পরেই স্বগতোক্তির মতো বলে চলেছেন, ‘তুমি দেখো নি আকাশে কী ক’রে মেঘ জমে, আহ্লাদে কতোটা রঙিন হ’তে পারে ডালিম ফুল। কেমনে পুকুরের আকাশে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছরাঙা। তার লাল তলোয়ারের মতো ঠোঁট ঢুকে যায় পাবদার লাল হৃৎপিণ্ডে। তুমি তা দেখো নি।’
মৌলির জন্ম শহরে, তাই লেখক তাঁকে তাঁর গ্রামের গল্প বলতে চাচ্ছেন। শহরে ঠিক কী কী জিনিসের অভাব, সেটা বলতে গিয়ে বলছেন, ‘শহরে কি চাঁদ ওঠে? কুয়াশা নামতে দেখিনি দুধের সরের মতো, পদ্মার পারে দেখি নি ধবধবে কাশফুলের শাদা মেঘ। কতো দিন দেখিনি ধানের গুচ্ছ, তারার গুচ্ছের মতো।’
বইটাজুড়ে গ্রাম–বাংলার প্রকৃতি থেকে শুরু করে জীবনপ্রণালি, অর্থনীতি, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, গ্রামের মানুষদের অসহায়তা ফুটে উঠেছে লেখকের বর্ণনায়। আর বইটা শেষ হয়েছে গ্রামের কীভাবে মৃত্যু হয়, তার বর্ণনা দিয়ে আর একেবারে শেষে লেখক বলে গেছেন তাঁর অনুভূতির কথা। এখনো কীভাবে তিনি তার শৈশবের গ্রামটাকে নিজের অন্তরে লালন করে চলেছেন, সেটার বর্ণনা পাঠককে মুগ্ধ করবে। আর সবশেষে আকুতি প্রকাশ করেছেন বারবার উনার গ্রাম রাড়িখালের কাছে ফিরে যাওয়ার।
পুরো বইটা পড়তে আপনার কখনোই একঘেয়ে লাগবে না। শুরুতেই আছে লেখকের বাড়ির বর্ণনা। লেখকদের বাড়িটি ছিল পুকুর দিয়ে ঘেরা। তার পায়ের নিচে সারাক্ষণ ঝুমঝুম করে বাজে পানির নূপুর। পুকুরের কচুরিপানার ফুল যেন ঝাড়বাতি। পুকুরে যেমন ছিল কচুরি ফুলের দীপাবলি তেমনি ডাঙ্গায় ছিল ঢলঢল কাঁচা লাউডগার স্বপ্ন। বাড়ির পাশেই আড়িয়ল বিলের উঁচু ভিটেতে চাষ করা হতো মরিচ, লাউ, কুমড়ো, টমেটো। সবাই সবুজ, সবাই ফুল ফোটায় আর ফল ধরে; কিন্তু তাদের কোনটি স্বপ্ন দেখে আকাশের, কোনটি দিগন্তের, কোনটি আপন শিকড়ের। সব গাছই তো স্বপ্ন দেখে আকাশের কিন্তু লাউডগা স্বপ্ন দেখে দিগন্তের। ঠিক এভাবেই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সবুজ উদ্ভিদগুলোর। পড়লে মনে হবে তারা যেন কোনো উদ্ভিদ নয়, তারা যেন এক–একটা জীবন্ত মানুষ।
হুমায়ুন আজাদ গ্রামের মানুষগুলোকে মোট তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। প্রথম রকম হচ্ছে ধনী মানুষেরা। তারা দেখতে বেশ সুন্দর, তাদের ছেলেমেয়েরা সুন্দর, তাদের লুঙ্গি সুন্দর, জামা সুন্দর। তারা কোনো কাজই করে না, গ্রাম শাসন করে। এরা কখনোই খেতে গিয়ে ধান বোনে না, মাছ ধরে না। তারা কাউকে সালামও দেয় না, অন্যরা শুধু সালাম দেয় তাদের। সুন্দর সুন্দর জামা পরে তারা দশটার দিকে চাকর নিয়ে বাজারে যায়। সড়কের মসৃণ জায়গা দিয়ে হাঁটে তারা, আর পথে পথে সালাম পায়। দ্বিতীয় রকমের মানুষেরা হচ্ছে তারা, যারা ধনী মানুষদের পেছনে পেছনে হাঁটে। গ্রামের লোকেরা এদেরও ভয় করে খুব; কেননা এরা নানা বিপদে ফেলে দেয় সরল মানুষদের। তৃতীয় শ্রেণির মানুষ হচ্ছে গরিব মানুষ, যারা সারা দিন শুধু কাজ করে। গরু নিয়ে মাঠে যায়, ধান বোনে, ঠান্ডা পানিতে নেমে মাছ ধরে, মাথায় করে ঘাস নিয়ে আসে। তারা মানুষের সঙ্গে যতটুকু কথা বলে, তার চেয়ে বেশি কথা বলে গরু, বাছুর ও মাঠের ধান ঘাস সবজির সঙ্গে। এ যেন হাজার বছরের গ্রাম–বাংলার মানুষের জীবনাচারের প্রতিচ্ছবি।
আবহমান গ্রাম–বাংলায় একটা সময় পুকুরভর্তি মাছ ছিল। কারণ, তখন পর্যন্ত খেতে সেইভাবে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়নি। লেখকদের বাড়ির পাশের পুকুরগুলোতেও বছরের একটা সময় সারা গ্রামের লোকজন মাছ ধরতে নামত বিভিন্ন প্রকারের যন্ত্র দিয়ে। কেউবা পলো দিয়ে, কেউবা বড়শি দিয়ে, কেউবা টেঁটা দিয়ে আর অনেকেই খালি হাতে মাছ ধরত। দিন শেষে সবাই অনেক মাছ নিয়ে নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেত। পুকুরে মাছও ছিল অনেক। মাছ ধরার পরে পুকুরের পানি ঘোলা হয়ে যায়। তখনকার পুকুরের অবস্থা বর্ণনা করে লেখক বলেছেন, ‘যখন আমি এ-শহরে, শহরকে আমার অনেক সময় ঘোলাজলের পুকুর বলেই মনে হয়, কাউকে ঘুরতে দেখি একা একা—বিষণ্ন, মলিন উস্কোখুস্কো, তখনি মনে পড়ে মানুষ নামার পরে পুকুরের ঘোলাজলের ভাসমান জীর্ণ কচুরিপানাগুলোকে। এমন কচুরিপানা-মানুষ দেখেছিলাম আমি একাত্তরে সাতাশে মার্চে।’ এভাবেই লেখক শহরের মানুষদের শিকড়হীনতাকে কচুরিপানার রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
এরপরই এসেছে গ্রামের টিনের চালের বৃষ্টির শব্দের কথা। বৃষ্টির মধ্যে চালের ওপর ডানা ঝাপটায় খেজুর আর আমি গাছ তখন স্বপ্নের মতো নিবিড় হয়ে ওঠে দশ দিক। এ ছাড়া শহর আর গ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক গ্রামকে তুলনা করেছেন ঘুমের সঙ্গে, শহরকে তুলনা করেছেন জেগে থাকার সঙ্গে। গ্রামের খেলাধুলার উপকরণগুলো সংগ্রহ করা হয় আশপাশের পরিবেশ থেকে। একটা সাধারণ জিনিস কারও হাতের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে বদলে হয়ে উঠত অনন্যসাধারণ খেলনা। লেখকের হোসেন মিয়া ভাই সামান্য খেজুরের ডালকে কেটে সুন্দর ঘোড়া বানিয়ে দিতেন, আর লেখক সেই ঘোড়ায় চড়ে সারা দিন টগবগ টগবগ করে বাড়িময় ঘুরে বেড়াতেন।
জীবিত মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে ক্ষুধা। সেটাও উঠে এসেছে এই বইয়ে। লেখকের ভাষায়, ‘ভাত ভাত ভাত—চারিদিকে শুনেছি—ভাত ভাত ভাত। এই তো বাঙলার চিরকালের পাখির গান, নদীর গান। বনের গান, রাখালের গান, চাষীর গান, বাউলের গান। গ্রামের গান, শহরের গান। সবুজ চারাগাছের মতো কিশোরের গান, পাতাঝরা শুকনো গাছের পাতার মতো বুড়োর গান—ভাত ভাত ভাত।’ লেখকের কাছে ভাতের আলাদা কোনো স্বাদ না থাকলেও উনাদের বাড়ির কাজের ছেলের মতে ‘ভাত খাইতে লাগে মদুর মতন’। অভাবী মানুষদের কাছে ভাতের বিকল্প হচ্ছে ভাতের মাড় বা ফ্যান। ভাত রান্না করা পাতিলের তলায় কালি জমে কালো হয়ে যাওয়ায় ফ্যানকে অনেকেই বলতেন: কালা গাইর দুধ। এই কালা গাইর দুধও গ্রামের অনেক অভাবী মানুষের প্রাণ বাঁচায়।
লেখকের নানাবাড়ি কামারগাঁয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্ত পদ্মা। পদ্মার ইলিশের স্বাদ গন্ধ নিয়ে আবহমান গ্রাম–বাংলায় এখনো কিছু গল্প প্রচলিত আছে, যেগুলো আমরাও আমাদের শৈশবে বড়দের কাছ থেকে শুনেছিলাম। ইলিশ মাছের পিঠের দিকের অংশটা হরিণের মাংস আর পেটের দিকের অংশটা ইলিশ মাছের নিজের মাংস। একবার প্রতিযোগিতা করে ইলিশ মাছের কাছে হেরে গিয়ে হরিণ তার শরীরের মাংস কেটে দিয়েছিল বাজির শর্ত মোতাবেক। এ ছাড়া ইলিশের মৌসুমে মাছ ধরার উৎসবের বর্ণনা এসেছে। লেখকও একবার মাছ ধরতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইলিশ মাছ পানি থেকে তোলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মারা যায়। এত সুন্দর ইলিশ মাছ কেন এত তাড়াতাড়ি মারা যায়, সেটা নিয়েও লেখকের শিশুমনে প্রশ্ন তৈরি হয়।
আবহমান গ্রাম–বাংলায় এখনো পুরোনো আমলের অনেক জমিদার বা কোনো বনেদি বংশের বাড়িঘর দেখা যায়। লেখকদের গ্রামেও এমন একটা বাড়ি ছিল। লেখকেরা তাঁদের শৈশবের ‘বুক অব নলেজ’ থেকে জেনেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর প্যারিস। তারপর থেকে লেখকদের কল্পনায় ভাসত প্যারিস শহর। গ্রামের বিলের ধারেই ছিল একটা মস্ত সুন্দর বাড়ি, লেখক যেটাকে প্যারিস শহরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ ছাড়া একটা বাড়ির প্রবেশপথের পাশেই মর্মর পাথরে খোদাই করা ছিল একটা শোকের কবিতা: ‘দাঁড়াও পথিকবর’। কবিতাটা দেখলেই লেখকের মন দুপুরের মতো উদাস হয়ে যেত। এ ছাড়া লেখকদের গ্রামে ছিল স্যার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মভিটা। গ্রামে উনাকে নিয়ে প্রচলিত ছিল অনেক গল্প। উনিই প্রথম রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন। উনার রেডিও আবিষ্কারকে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন মার্কনি। আসলেই গ্রাম–বাংলায় এখনো অনেক গল্প প্রচলিত আছে স্থানীয় বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে। আর লেখকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামও ছিল ‘স্যার জে সি বোস ইনস্টিটিউশন’।
গ্রাম–বাংলায় একসময় প্রতিবছর মেলা বসত। সেই মেলায় থাকত সার্কাস, যাত্রা আর বিভিন্ন রকমের মনকাড়া বাহারি পণ্যের দোকান। হাওয়ায় মিঠাই ছিল একটা অবাক করা খাবার। ইয়াব্বড় একটা গোলা মুখের মধ্যে দিলেই গলে যেত। সার্কাসে দেখানো হতো হৃদয়ে কাঁপন ধরানো সব খেলা। আর সবার মন জুগিয়ে চলত সার্কাসের জোকার। তার কার্যক্রম সার্কাসের বিপজ্জনক সব খেলাকে করে তুলত আরও বেশি উপভোগ্য। সার্কাসের এসব বিপজ্জনক খেলা দেখাতে গিয়ে অনেক মানুষই সেই খেলার হাতে বেঘোরে প্রাণ দিত। এমন গল্পই প্রচলিত ছিল মানুষের মুখে মুখে, তবু বংশপরম্পরায় সেই খেলাগুলো চালিয়ে নিত বংশের কেউ। আর যাত্রা প্যান্ডেলে যাত্রা দেখা এক দারুণ অভিজ্ঞতা। যাত্রার কর্মীদের পোশাক মেকআপ হতো খুবই চাকচিক্যময়। আর তাদের উচ্চারণের ভিন্নতার কারণে সংলাপগুলো সবার মুখস্থ হয়ে যেত এমনিতেই। আর এই মেলা উপলক্ষে লেখকের নানির বাড়ি যাওয়া হতো। লেখকের মামি লেখককে দেখেই উল্লসিত হয়ে ডাকতেন, ‘আমার বাজান আইছে’। এরপর শুরু হতো গ্রাম–বাংলার সেই বিখ্যাত মামাবাড়ির আপ্যায়ন, যার কথা বাংলাদেশের কবিতায় বলা হয়। মামি দিলো দুধভাত পেটভরে খায়, মামা এলো লাঠি নিয়ে পালাই পালাই পালাই।
এরপরই এসেছে লেখকের মনে সুখ আর শোকের অনুভূতি তৈরির কথা। কবিতা লেখকের বরাবরই ভালো লাগত। কীভাবে লাইনের শেষে শব্দগুলো একই ছন্দে মিলে যাচ্ছে, সেটা ছিল এক বিরাট বিস্ময়। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে কে বড়, সেটা নিয়ে চলত অবিরাম তর্ক। সেই তর্কের একটা দুর্দান্ত সমাধান দিয়েছিলেন লেখকের ক্লাসের এক স্যার। উনি বলেছিলেন, এখন মনে হবে কাজী নজরুল ইসলাম বড় কবি, বয়স বাড়লে মনে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড় কবি।
লেখকের পাঠ করা প্রথম শোকের কবিতার নাম ছিল ‘কাজলা দিদি’, কবির নাম যতীন্দ্রমোহন বাগচী। এই কবিতায় বর্ণনা করা প্রকৃতির সঙ্গে গ্রাম–বাংলার প্রতিটি গ্রামের প্রকৃতি মিলে যায়। আর কাজলা দিদি যে আর বেঁচে নেই, সেটা শিশুমনে গাঢ় ক্ষত তৈরি করে। আর দ্বিতীয় কবিতার নাম ছিল ‘ছিন্ন মুকুল’, কবির নাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কবিতার শুরুতেই বলা হচ্ছে, ‘সবচেয়ে যে ছোট্ট পীড়িখানি, সেইখানি আর কেউ রাখে না পেতে’। কারণ, সেই পিঁড়িতে যে বসত, সে আর এই পৃথিবীতে নেই। ছিন্ন মুকুল কবিতার বিষয়বস্তু লেখকের জীবনে আসে নির্মম বাস্তবতা হয়ে। গ্রাম–বাংলায় একসময় কলেরায় বহু মানুষ মারা যেত। বলা হতো, কলেরার বাহকওয়ালা বিবি পদ্মার পাড় দিয়ে আঁচল ছেড়ে দিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছেন আর গ্রামের পর গ্রাম কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে। লেখকদের গ্রামে সাধারণত কলেরা দেখা দেয়নি, কিন্তু সেবার কলেরা দেখা দিল। হঠাৎ মাঝরাতে লেখকের ছোট ভাই সাড়ে তিন বছরের আবুল কালাম আজাদ আক্রান্ত হলো। আবুল কালাম আজাদ অনেক কথা বলত। সে বলতে লাগল, সে মরবে না বেঁচে যাবে। বড় ডাক্তার নিয়ে আসলেই সে বেঁচে যাবে। লেখক সেই মাঝরাতেই ডাক্তার আনতে যেতে চাইল, কিন্তু লেখকের বাবা রাজি না হওয়ায় আর সেই যাত্রা সফল হলো না। সকালে লেখকের বাবা ডাক্তার আনতে বেরিয়ে গেলেন। উনি যখন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে নিয়ে ফিরলেন, তখন আবুল কালাম আজাদ মারা গেছেন। লেখক বলেছেন, ঠিক সময়ে ডাক্তারকে না ডাকার কারণে তিনি তার বাবাকে আর ক্ষমা করেননি বাকি জীবন। এরপর আবুল কালাম আজাদের নামের শেষের অংশ লেখক তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে নেন।
এরপর এসেছে গ্রামের মৃত্যুর প্রসঙ্গ। গ্রামের মৃত্যু হয় কীভাবে? লেখকের ভাষায় গ্রামে যখন বিদ্যুৎ আর ভাঙা জিপ এল, তখন থেকেই গ্রামের মৃত্যুর প্রক্রিয়া শুরু হলো। লেখকের ভাষায়, ‘ভাঙা জীপে চড়ে বসেছে আমাদের গ্রাম। সারাদেশ। আর বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে এখানে সেখানে।…রাড়িখাল এখন জড়িয়ে গেছে ছেঁড়া বিদ্যুতের তারে। আমাদের শহরগুলো কোনদিন শহর হবে না। হবে বস্তি। আমাদের গ্রামগুলো আর গ্রাম থাকবে না। হয়ে উঠবে বস্তি।’
লেখক আক্ষেপ করে আরও বলছেন, ‘গ্রাম ম’রে যাচ্ছে। পুকুর ম’রে যাচ্ছে। পদ্মা ম’রে যাচ্ছে। ধানখেত ম’রে যাচ্ছে। শুধু ভাঙা জীপের শব্দ উঠছে। ছেঁড়া তার জড়িয়ে ধরছে। ভাঙা জীপে চ’ড়ে রাস্তার পাশে মুখ থুবড়ে প’ড়ে গেছে রাড়িখাল। … চারিদিকে শুধু পাগলের করতাল।’
পরিশেষে রয়েছে লেখকের শৈশবের গ্রাম রাড়িখালের জন্য লেখকের ভালোবাসার প্রকাশ। লেখকের ভাষায়, ‘আমি আছিলাম পোনর বচ্ছর ছয় মাস তোমার ভিৎরে। থাকুম পোনর শ বচ্ছর। আমার যে মন পোড়ে। আমার যে মন পোড়ে কালো কাউয়ার লিগা, কইতরের বাচ্চার লিগা, বাইগন গাছের লিগা, ঘাডের পানির লিগা।’ লেখক তাঁর আবেগকে প্রকাশ করতে গিয়ে ব্যাকরণ শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার না করে একেবারে রাড়িখালের স্থানীয় কথ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবেই যেন আবেগটা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। লেখক অনেক বড় হয়ে যাওয়ার পরও রাড়িখালের দিনগুলো ভেবে সময় পার করেন আর প্রতিনিয়ত তার বুকের মধ্যে রাড়িখালের জন্য ভালোবাসা বাড়তে থাকে। লেখকের ভাষায়, ‘রারিকাল। রারিকাল। আমি কত ডাক পারি। তুমি ক্যান হুমইর দ্যাও না।’
বাংলা ভাষাভাষী যেকোনো বয়সী পাঠ্যকের জন্য ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটা উপভোগ্য হবে বলেই আমার বিশ্বাস। বয়স্করা তাঁদের শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যাবেন নিশ্চিতভাবেই, আর শিশুরা জানবে এমনও একটা অনাড়ম্বর ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের শৈশবে যেখানে ছিল না সিলেবাসের চোখ রাঙানি, ছিল না তেমন কোনো খেলার উপকরণ; তবু ছিল প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বিনা মূল্যের খেলনা দিয়ে খেলার অপার আনন্দ। পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলোর একটা ছোঁয়া পাওয়া যাবে বইটি পড়লে। যার শৈশবের স্মৃতি যত বেশি বর্ণিল, তার ভবিষ্যৎ তত বেশি উজ্জ্বল। আমি বলছি না সফল; কারণ, সময়ের ব্যবধানে সফলতার মাপকাঠিও বদলে যায় কিন্তু শৈশবের স্মৃতি অবধারিতভাবেই ভবিষ্যৎ জীবনের খারাপ সময়টা অতিক্রম করতে অনেক সাহায্য করে। বর্তমান বিশ্বে যান্ত্রিকতার জাঁতাকলে আমাদের জীবন অতিমাত্রায় অতিষ্ঠ। আমরা এক–একজন কলের পুতুল হয়ে গেছি। ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ পাঠ সেখানে বয়ে নিয়ে আসবে পদ্মাপাড়ের একমুঠো হিমেল বাতাস।