চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একপ্রকার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারাজ। আজ তার সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করার বয়স শেষ। মন খারাপের এই দিনে তার বাবার মুখটি খুব করে মনে পড়ছে। বাবা তাকে কত বার বকেছে বিসিএস দিয়ে সরকারী চাকরী করতে। ফারাজের বন্ধু নাবিল আজ কত বড় সরকারী চাকুরী করছে। অথচ সে আজ কোথায়?
দোস্ত, প্রতিদিন মনে হয় চাকুরীটা ছেড়ে দেই। আর ভাল্লাগেনা। শুক্কুর বার টা এত ছোট কেন রে? জানিস, শনিবার এলেই না – আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আবার অফিস… আবার আমার বসের ওই নিরামিষ মার্কা চেহারাটা দেখতে আর ইচ্ছে করে না।ব্যাটা পুরাই একটা খ্যাঁত! বিশ্বাস কর, স্ত্রী-সন্তান না থাকলে সেই কবেই চাকুরীটা ছেড়েই দিতাম। একপ্রকার হতাশ হয়েই ফারাজ একটানা বলে যাচ্ছে। নাবিল ও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেই যাচ্ছে ফারাজের হতাশার গল্প। নাবিলের মনে পড়ছে ফারাজ যখন লাইব্রেরীতে বই নিয়ে পড়ে থাকত, তখন সে ক্যাম্পাসে স্লোগান দিত ” অমুকের বাংলায় তমুকের স্থান নাই!” সরকার বিরোধী আন্দোলনের ফলে নাবিল ২ মাস জেল ও খেটেছিল সে সময়।
দোস্ত, আমরা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি, তারা জানি আমাদের জগত টা কত বিশাল ছিল! সেখানে আমার বসকে দেখে আমার একটা কুয়োর ব্যাঙ মনে হয়। ওই ব্যাটা মফঃস্বলের কোন নাম না জানা কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে কেবল মালিক পক্ষের আস্থাভাজন হয়ে বছর যেতে না যেতেই প্রমোশন আর বেতন বাড়িয়ে কোম্পানিতে তার একটা শক্ত অবস্থান তৈরী করে নিয়েছে। আর আমি শালা গত পাঁচ বছরে একই পদে আছি। বেতন বেড়েছে ৬ হাজার টাকা আর খরচ বেড়েছে তার তিন গুন। নাবিল সিগারেট টা ধরিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে ফারাজের কথা শুনছে। ফারাজ ও অনেক দিন পর নাবিল কে পেয়ে যেন তার কষ্টের আকাশের কালো মেঘ গুলো সরিয়ে খানিকটা হাল্কা বোধ করছে।
নাবিল ফারাজকে আস্তে করে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় – “তোর বসের আজকের অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বড় কোন কোয়ালিটি আছে বলে তুই মনে করিস?” ফারাজ একটু অপ্রস্তুত হয়ে এক কোথায় উত্তর দিল – “কোম্পানীর প্রতি তার কমিটমেন্ট”।
নাবিল ফারাজের উত্তরে খানিকটা অবাক হয়ে বল্ল – যাক, তুই একটা ভালো পয়েন্ট তুলে ধরেছিস। এই কোয়ালিটি টা একটা প্রফেশনালের জন্য অনেক ইম্পরটেন্ট। এবার সে ফারাজকে একটা একটা করে বিষয় পরিষ্কার করে দিল।
দেখ ফারাজ, ক্যারিয়ারে প্রথম কয়টা বছর তোকে বুঝতে হবে তোকে কেন কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছে? সে পদের জন্য তোর কি কি দক্ষতা প্রয়োজন ছিল? কি কি তোর আছে? তুই ক্যাম্পাসে অনেক ব্রিলিয়েন্ট ছিলি এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি ক্যাম্পাস জীবন আর কর্ম জীবন এক নয় তাও বাস্তব। এখানে আছে নানা মুখী চ্যালেঞ্জ । এডুকেশন লাইফ ছিল একমুখী। তুই যা পড়বি তাই শিখবি। কিন্তু কর্মজীবনে ৩৬০ ডিগ্রী চ্যালেঞ্জ । আর তা মোকাবেলা করতে পুঁথিগত বিদ্যা অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ে।
কর্মজীবনে এসে এ কয় বছর তুই কয়টা ট্রেনিং এ অংশগ্রহণ করেছিস? ফারাজ এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলে উঠে – ধুর ব্যাটা, যারা ট্রেনিং করায় তারা কি আমার থেকে বেশি বুঝে? নাবিল ফারাজের সমস্যাটা উপলব্ধি করতে পারে। ফারাজ মারাত্মক Supiority Complex এ ভুগছে। নাবিল উত্তরে বলে উঠে – বন্ধু, যারা কর্মবিষয়ক এই ট্রেনিং গুলো করায় তারা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কিভাবে করেছে তা তুলে ধরে। তুই অনেক জ্ঞানী হতে পারিস কিন্তু প্রফেশনাল লাইফে সাকসেসফুল হতে হলে তোকে দক্ষ্য হতেই হবে।
এবার আসি তোর বসের একাডেমিক দিক নিয়ে। আমি মানলাম তোর তার চাইতে অনেক ভালো একাডেমিক রেজাল্ট। আরে ভাই, তোকে এ কারনেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে যাতে করে তার শূন্যতা তুই পূরণ করতে পারিস। আমি যতদূর জানি তোর বাবা তোর মত শিক্ষিত নন। তাই বলে কি তুই তোর বাবা কে অবজ্ঞা করবি? কর্মজীবন হচ্ছে একটা টিম ওয়ার্ক এর জায়গা। এখানে সবার ইনপুট নিয়ে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন করতে হয়।
আমি ব্যাক্তিগত ভাবে ” চেয়ার” কে পুজো করি । একটা চেয়ারই মানুষকে গড়ে তোলে। আবার ওই চেয়ার কে পেতে হলে আমাদের ব্যাক্তিগত EGO কে বাদ দিয়ে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করতে হবে। আমাকে কোথায় যেতে হবে? কবে যেতে হবে? কিভাবে যেতে হবে? যেতে হলে কি কি দক্ষ্যতা অর্জন করতে হবে? কাদের সাথে যেতে হবে? তুই যদি ভাবিস তোর একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন হয়ে গেছে, তুই নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত, তবে তোকেই খুঁজবে নতুন কোন চেয়ার। তোকে চেয়ারের পেছনে ছুটতে হবে না বন্ধু।
ফারাজ অবাক হয়ে নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে – ইস্” মিথ্যে অহম” নিয়ে কাটিয়ে দেয়া দিনগুলো যদি আবার ফিরে পেতাম !
নূর ফয়সল
২৭ নভেম্বর, উত্তরা, ঢাকা।
লেখক ও মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মী